অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম আশীর্বাদ অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ড্রাগ আবিষ্কার। এটি এমন একধরনের ওষুধ যা মানুষ এবং পশু উভয়ের শরীরেই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত রোগ এবং ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এরা ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলে অথবা ব্যাকটেরিয়ার দৈহিক বৃদ্ধি ও বংশবিস্তারে বাধা দেয়।এদের ব্যাবহারের মাধ্যমে এমন অনেক রোগের চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে, যেগুলোর কারণে একসময় মানুষ মারা পর্যন্ত যেত। কিন্তু এখন অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ খেয়ে মানুষ কয়েকদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যায়। তবে অ্যান্টিবায়োটিক কেবল নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়াজনিত ইনফেকশনই প্রতিরোধ করে। ভাইরাসের উপর এরা কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।

অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে মানুষ ও পশুপাখি রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে চিকিৎসা না থাকায় মারা যেত। রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর ধ্বংস বা বংশবিস্তার রোধের ওপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ১৯২৮ সালে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু এর অযাচিত ব্যবহারের কারণে বর্তমানে সংক্রমণকারী জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারাচ্ছে।

ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস বা তার বংশবৃদ্ধি রোধ করার জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা হ্রাস অথবা কমে যাওয়াকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। সব ওষুধই কার্যকারিতা হারায়; কিন্তু অন্যান্য ওষুধের কার্যকারিতা হারানো অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা হারানো থেকে ভিন্ন। যখন মানুষের শরীরে কোন পরিবর্তন সংঘটিত হয় তখন অন্যান্য ওষুধ অকার্যকর হয়ে পড়ে। আর অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা হারানোর অর্থ হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে জীবাণুগুলোর মধ্যে পরিবর্তন হয়, জীবাণুগুলো অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার সামর্থ্য অর্জন করে। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক আর তাদের মারতে পারে না। অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের পরেও ব্যাকটেরিয়ার এই টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জনকে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বা অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স বলা হয়।অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার সক্ষমতা অর্জন করা ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া।


এসব ব্যাকটেরিয়া তার নিজের জেনেটিক কোডে এমন পরিবর্তন আনে যে সেই অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণুকে ধ্বংস বা তার বংশবিস্তার রোধ করতে পারে না। সাথে করে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বংশ বিস্তার করে, যার ফলে অতি অল্প সময়ে লাখ লাখ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া তৈরি করতে পারে।রেজিস্ট্যান্সপ্রাপ্ত ব্যাক্টেরিয়াগুলো যখন দেহ থেকে বের হয়ে প্রকৃতিতে যায় তখন অন্য সাধারণ ব্যাক্টেরিয়াগুলোকেও রেজিস্ট্যান্স করে ফেলে। ফলশ্রুতিতে যে এন্টিবায়োটিক আগে কাজ করত তখন তা সাধারণ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধেও আর কাজ করে না। ফলে একই এন্টিবায়োটিকের মাধ্যমে পরবর্তিতে আর রোগ সারেনা। নতুন কোন এন্টিবায়োটিক বা অতিরিক্ত মাত্রার ডোজের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে সংক্রমণের  চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে ওঠে এবং রোগের বিস্তার ঘটে, অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে।

সময়ের সাথে সাথে ব্যাকটেরিয়াদের অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ক্ষমতা লাভের প্রবণতা বেড়ে চলেছে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো সাম্প্রতিক সময়ে অত্যধিক মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার। সামান্য কোনো অসুখ হলেই মানুষ অ্যান্টিবায়োটিকের দিকে ঝুঁকছে। আমরা যখন রোগাক্রান্ত হই তখন ডাক্তার আমাদের রক্ত ও অন্যান্য নুমনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠান এবং রোগের জন্য দায়ী ব্যাক্টেরিয়া নির্ণয় করে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য কিছু ঔষধ দিয়ে থাকেন। কিছু ঔষধ খাওয়ার পর খানিকটা ভালো অনুভব করলেই অনেকে মনে করে আমিতো ভালোই হয়ে গেছি, আর ঔষধ খাওয়ার কি দরকার? ঔষধ খাওয়া ছেড়ে দেয় এবং ডাক্তারের দেয়া এন্টিবায়োটিকের কোর্স পূর্ণ করেনা। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ব্যতিক্রমী দুই-এক ক্ষেত্রে রোগীর দেহে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া থেকে যাচ্ছে যাদের উপর অ্যান্টিবায়োটিক কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। এদিকে তারা অ্যান্টিবায়োটিকের সান্নিধ্যে আসার মাধ্যমে, অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৌশল শিখে ফেলছে, এবং পরবর্তীতে তাদের মাধ্যমে সৃষ্ট নতুন ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও একই গুণাগুণ দেখা দিচ্ছে। এভাবে একজনের শরীরে এক প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ক্ষমতা লাভ করলে, পরবর্তীতে সেটি অন্য আরো অনেকের শরীরেও সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
যে কারণে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে তার মধ্যে আছে প্রয়োজন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা, সঠিক পরিমাণে এবং সময়মতো অ্যান্টিবায়োটিক না নেওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই নিজের ইচ্ছামতো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা।

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধ করার জন্য যে কাজগুলোকরা যায় তা হল,
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করা। চিকিৎসকের পরামর্শমতো সঠিক মাত্রায় ও নিয়ম অনুসারে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা। ঠাণ্ডা লাগা বা সর্দিজ্বর সাধারণত ভাইরাসের আক্রমণে হয়ে থাকে। আর ভাইরাসের উপর এন্টিবায়োটিক কোন কাজ করতে পারেনা। ভাইরাসজনিত জ্বর, সর্দি, কাশির ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করা। ভেজাল এবং মেয়াদোত্তীর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক সেবন না করা।  এর সাথে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করতে হবে। নিবন্ধনকৃত চিকিৎসকের লিখিত প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা যাবে না মর্মে বিজ্ঞ হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা।

ডাঃ মোঃ মাশুক রহমান
এমবিবিএস (ঢাকা মেডিকেল কলেজ) বিসিএস (স্বাস্থ্য)