জ্যামিতির ইতিহাস

প্রাচীনকালে জ্যামিতির গোড়াপত্তন
প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোতে জ্যামিতি চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায়। বৈদিক যুগে বেদি তৈরিতে নির্দিষ্ট
জ্যামিতিক আকার ও ক্ষেত্রফল মেনে চলা হতো। এগুলো প্রধানত ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ও ট্রাপিজিয়াম আকারের
সমন্বয়ে গঠিত হতো। প্রাচীন মিশরে আনুমানিক চার হাজার বছর আগেই ভূমি জরিপের কাজে জ্যামিতির
ধ্যান-ধারণা ব্যবহার করা হতো। প্রাচীন মিশর, ব্যাবিলন, ভারত, চীন, ইনকা ও সিন্ধু সভ্যতার স্থাপত্যগুলো
অতিসূক্ষ্ম জ্যামিতিক আকারে তৈরি। প্রাচীন সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতায় জ্যামিতির বহুল ব্যবহার ছিল। হরপ্পা ও
মহেঞ্জোদারোর খননে সুপরিকল্পিত নগরীর অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে। শহরের রাস্তাগুলো ছিল সমান্তরাল এবং
ভূগর্ভস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল উন্নত। তাছাড়া ঘরবাড়ির আকার দেখে বোঝা যায় যে, শহরের অধিবাসীরা ভূমি
পরিমাপেও দক্ষ ছিলেন।

তবে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার যুগেই জ্যামিতির প্রণালীবদ্ধ রূপটি সৃস্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়। গ্রিক গণিতবিদ
থেলিসকে প্রথম জ্যামিতিক প্রমাণের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তিনি ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বের দিকে গ্রিসে বাস করতেন। তাকে
অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপপাদ্যের জনক হিসাবে গণ্য করা হয়। এদের মধ্যে অন্যতম হল “অর্ধবৃত্তস্থিত কোণ এক সমকোণ”। এছাড়াও তিনি যুক্তিমূলক প্রমাণ দেন যে, ব্যাস দ্বারা বৃত্ত সমদ্বিখন্ডিত হয়। তিনিই প্রথম পিরামিডের উচ্চতা ও সমুদ্র তীর থেকে জাহাজের দূরত্ব নির্ণয়ের জন্য জ্যামিতি ব্যবহার করেন।

থেলিসের পরে তাঁর শিষ্য পিথাগোরাস জ্যামিতিক তত্ত্বের বিস্তৃতি ঘটান। পিথাগোরাস (570BC -500BC) গণিতের ইতিহাসে প্রথম প্রকৃত গণিতবিদ হিসেবে স্বীকৃত। পিথাগোরাস ও তাঁর সহযোগীরা ত্রিভুজ, বৃত্ত, অনুপাত ও কিছু কিছু ঘনবস্তুর জন্য অনেক নতুন নতুন উপপাদ্য প্রমাণ করেন। পিথাগোরাসের সবচেয়ে বিখ্যাত উপপাদ্যটি হলো- “সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল অপর দুই বাহুর উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলের সমষ্টির
সমান”। উপপাদ্যটি বর্তমানে তাঁর নামে নামান্বিত। পিথাগোরাসকে সাধারণত “পিথাগোরাসের উপপাদ্য” এর জন্য সমাদৃত করা হয়। যদিও ঐ উপপাদ্যটি পূর্বে
ব্যাবিলন ও ভারতীয় সভ্যতায় ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে এটি প্রচলিত যে তিনি বা তাঁর অনুসারীরাই এটি সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে গ্রিক প-িত ইউক্লিড সর্বপ্রথম জ্যামিতির বিভিন্ন ছড়িয়ে থাকা উপপাদ্য ও স্বতঃসিদ্ধগুলি বিধিবদ্ধভাবে সুবিন্যস্ত করে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ELEMENTS রচনা করেন। তাঁর রচিত ইলিমেন্টস গ্রন্থটি সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী পাঠ্যপুস্তক হিসাবে বিবেচিত হয় এবং বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত
পশ্চিমের সমস্ত শিক্ষিত লোকের কাছেই বইটি পরিচিত ছিল। তের খ- পে্রকাশিত সম্পূর্ণ কালোত্তীর্ণ এই “ইলিমেন্টস” গ্রন্থটিই আধুনিক জ্যামিতির ভিত্তিস্বরূপ।

মধ্যযুগে জ্যামিতি শাস্ত্রের বিকাশ
৫ম শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৫শ শতক পর্যন্ত ইউরোপে জ্যামিতির তেমন উন্নতিসাধন হয়নি। এসময় ইউরোপ অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে এবং উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানেরা এবং ভারতের হিন্দুরা জ্যামিতির বেশির ভাগ উন্নতি সাধন করেন। গ্রিক গণিতের বেশির ভাগই ছড়িয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে
যায়। ৬ষ্ঠ শতকের ভারতীয় গণিতবিদ আর্যভট্ট সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের ক্ষেত্রফলের সূত্র পুনরাবিষ্কার করেন। এছাড়াও তিনি পাই ()-এর অত্যন্ত সঠিক মানের
একটি সূত্র দান করেন। তিনি পাই (PI) -এর মান ধরেন ৬২৮৩২/২০০০০, বা ৩.১৪১৬, যা দশমিকের পর চার ঘর পর্যন্ত পাই (PI) -এর সঠিক মান।

মুসলিম গণিতবিদরাই সর্বপ্রথম বীজগণিতকে জ্যামিতির ভেতর প্রবেশ করান এবং বীজগণিতের সমীকরণের মাধ্যমে জ্যামিতির বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন। আল বিরুনী (৯৭৩-১০৪৮) গণিতশাস্ত্রে বিশ্ববিখ্যাত ছিলেন। তিনি জোতির্বিজ্ঞানে জ্যামিতির প্রয়োগ করেন। তিনি জ্যামিতির সাহায্যে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ
এবং পরিধি নির্ণয়ের পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর গ্রন্থ ‘আল-কানুন আল মাসউদী’ কে গণিতশাস্ত্রের বিশ্বকোষ বলা হয়। এতে জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, ক্যালকুলাস
প্রভৃতি বিষয়ের সূক্ষ্ম, জটিল ও গাণিতিক সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত চমৎকার আলোচনা করা হয়েছে। এ গ্রন্থেই তিনি পৃথিবীর পরিমাপ সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন, বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে তা আজও প্রতিষ্ঠিত।

ইবনুল হাইসাম (৯৬৫-১০৩৯) তাঁর প্রণীত ”The Theorem of Ibn Haytham” এর মাধ্যমে প্রথম জ্যামিতিক গণনার সাহায্যে পৃথিবীর যেকোনো দুটি স্থানের মধ্যে দূরত্ব নির্ণয় করেন। তিনি জ্যামিতিক উপায়ে সমষ্টি নির্ণয়ের পদ্ধতি প্রমাণ করেন। The lunes of Alhazen তাঁরই প্রণীত। তিনি বিশুদ্ধ গণিতের
উপর ৪১টি এবং জ্যামিতির উপর ২৬টি গ্রন্থের প্রণেতা।

ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১৩১) প্রথম উপবৃত্ত ও বৃত্তের ছেদকের সাহায্যে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করেন। জ্যামিতিতে তাঁর একটি বড় অবদান হলো ইউক্লিডের
সমান্তরাল স্বীকার্যের সমালোচনা যা পরবর্তী সময়ে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সূচনা করে।
১২শ ও ১৩শ শতকে ইউক্লিডের এলিমেন্টস গ্রন্থটি গ্রিক ও আরবি থেকে লাতিন ও আধুনিক ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয় এবং ধর্মীয় শিক্ষালয়ে জ্যামিতি শিক্ষা যোগ করা হয়।

আধুনিক কালে জ্যামিতি
সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে জ্যামিতিতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছিল। ফরাসি দার্শনিক ও গণিতবিদ রেনে দেকার্তে জ্যামিতিকে সামনের দিকে এগিয়ে দেন।
১৬৩৭ সালে তাঁর প্রভাবশালী রচনা Discourse on Method প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি স্থানাঙ্ক ব্যবস্থার সাহায্যে জ্যামিতিক আকৃতি প্রকাশের পদ্ধতি
উপস্থাপন করেন। তাঁর কাজ জ্যামিতি ও বীজগণিতের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। এই যোগসূত্রই বিশ্লেষণী জ্যামিতি এবং আধুনিক জ্যামিতির ভিত্তি।

১৭শ শতকের জ্যামিতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল অভিক্ষেপী জ্যামিতির উদ্ভাবন। অভিক্ষেপী জ্যামিতিতে কোনো জ্যামিতিক বস্তুর এক তল থেকে আরেক তলে অভিক্ষেপ ফেললে এর ধর্মের কী পরিবর্তন ঘটে তা নিয়ে গবেষণা করা হয়। জেরার দ্যজার্গ নামের এক ফরাসি প্রকৌশলী perspective নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে
অভিক্ষেপী জ্যামিতি উদ্ভাবন করেন। ১৮শ শতকে গাসপার মোঁজ নামের ফরাসি এক গণিতের অধ্যাপক বিবরণমূলক জ্যামিতি নামে জ্যামিতির আরেকটি শাখা উদ্ভাবন করেন। বিবরণমূলক জ্যামিতিতে দ্বি-মাত্রিক চিত্রের সাহায্যে ত্রিমাত্রিক বস্তুসমূহকে কীভাবে ত্রুটিহীনভাবে উপস্থাপন করা যায় এবং এর সাহায্যে কীভাবে
ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির নানা সমস্যা সমাধান করা যায়, তার আলোচনা করা হয়। প্রকৌশল ও স্থাপত্যের অঙ্কনের ভিত্তি হলো এই বিবরণমূলক জ্যামিতি।
ইউক্লিডীয় জ্যামিতির কাঠামোর ভেতরেই বিশ্লেষণী, অভিক্ষেপী ও বিবরণমূলক জ্যামিতির আবির্ভাব ঘটে। বহু শতাব্দী ধরে গণিতবিদেরা বিশ্বাস করতেন যে
অনন্য সমান্তরাল রেখা সংক্রান্ত ইউক্লিডের পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধটি বাকী চারটি স্বতঃসিদ্ধ থেকে প্রমাণ করা যাবে, কিন্তু এই প্রমাণ বের করার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
১৯শ শতকে এসে নতুন নতুন জ্যামিতিক ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা হয় যেগুলিতে ইউক্লিডের পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধটিকে অন্য কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। এইসব নতুন ধরনের
অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দেন কার্ল ফ্রিড্রিশ গাউস, ইয়ানোশ বলিয়ই, নিকলাই লবাচেভিস্ক এবং গেয়র্গ ফ্রিড্রিশ বের্নহার্ট রিমান ।

১৮৭২ সালে জার্মান গণিতবিদ ফেলিক্স ক্লাইন গণিতের একটি অপেক্ষাকৃত নবীন শাখা গ্রুপ তত্ত্ব ব্যবহার করে তার সময়কার সমস্ত জ্যামিতিক ব্যবস্থাগুলিকে এক
ব্যবস্থার অধীনে আনেন। ১৮৯৯ সালে আরেকজন জার্মান গণিতবিদ ডাভিড হিলবের্ট তাঁর Foundations of Geometry বইটি প্রকাশ করেন, যাতে
ইউক্লিডীয় জ্যামিতির জন্য স্বতঃসিদ্ধসমূহের একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা প্রদান করা হয় এবং এটি গণিতের অন্যান্য শাখায় গভীর প্রভাব ফেলে।
১৯১৬ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে দেখা যায় অনেক ভৌত ঘটনা জ্যামিতিক মূলনীতি থেকে উপনীত হওয়া সম্ভব। এই তত্ত্বের সাফল্য অন্তরক জ্যামিতি ও টপোগণিতের গবেষণায় জোয়ার আনে। ১৯শ শতকের ব্রিটিশ গণিতবিদ আর্থার কেলি চার বা তারও বেশি মাত্রার জ্যামিতি প্রবর্তন করেন।
১৯শ শতকে ফ্র্যাক্টাল মাত্রার আলোচনা শুরু হয়। ১৯৭০-এর দশকে ফ্র্যাক্টালের ধারণা কাজে লাগিয়ে জ্যামিতির নতুন শাখা ফ্র্যাক্টাল জ্যামিতির উদ্ভব হয়। বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রার দিকে যেকোনো সীমাবদ্ধক্ষেত্র ব্যাখ্যায় বীজগণিতীয় জ্যামিতি (Algebraic Geometry) ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এমনকি মহাকাশ গবেষণাতেও ব্যবহৃত হচ্ছে জ্যামিতিক ধারণা।

জ্যামিতির এই অগ্রযাত্রাকে আরো ত্বরান্বিত করতে তোমার দিকে চেয়ে আছে বিশ্ববাসী…


তথ্য উৎস্য:

দি রয়েল সায়েন্টিফিক পাবলিকেশন্স কর্তৃক প্রকাশিত

Geometry Boss (SSC Level)

বইটির কিছু অংশ পড়ে দেখতে ক্লিক করুন  Geometry Boss (SSC Level)

লেখাঃ Mehdi Mehetab Shihab
BSc. BUET