লুই পাস্তুর: জীবাণুতত্ত্বের জনক

১৮৮১ সালের ৫ই মে। স্থান ফ্রান্সের পুঁইয়ই (Pouilly) দুর্গ। একদল লোক হাজির হয়েছে এক কাজ-পাগল বিজ্ঞানীর কর্মকাণ্ড দেখতে। সেখানে জড়ো করা হয়েছে ৫০ টি ভেড়া। ফ্রান্সে গরু-ছাগল-ভেড়ার অর্ধেক মারা যেত অ্যানথ্রাক্স রোগে। সেই বিজ্ঞানী করলেন কি! ঐ ৫০টি ভেড়ার ২৫টির দেহে প্রবেশ করানো হল অ্যানথ্রাক্সের বাসি দুর্বল জীবাণু। যেসব ভেড়ার দেহে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু প্রবেশ করানো হল তাদের কান ফুটো করে দেওয়া হল সহজে চিনে রাখার জন্য। এর কয়েকদিন পর ৫০টি ভেড়ার দেহেই প্রবেশ করানো হল শক্তিশালী অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু। দেখা গেল, যে ২৫টি ভেড়ার দেহে আগে দুর্বল জীবাণু প্রবেশ করানো হয়েছিল এইবার শক্তিশালী জীবাণু তাদেরকে কাবু করতে পারল না। আর যেসব ভেড়া আগে জীবাণুমুক্ত ছিল, সেসব ভেড়ার দেহে শক্তিশালী জীবাণু প্রবেশ করানোর কারণে মারা গেল।


চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল ঐ বিজ্ঞানীর। কারণ, ঐ বিজ্ঞানী অ্যানথ্রাক্সের টিকা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। বিজ্ঞানীর নাম লুই পাস্তুর (Louis Pasteur)। তাঁর আবিষ্কারের কল্যাণে লক্ষ লক্ষ ভেড়াকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল।


লুই পাস্তুর ১৮২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ফ্রান্সের এক গরিব ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কাজ করতেন ট্যানারী কারখানায়। আর মা ছিলেন বাগানের মালিনী। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকায় বেশ ভাল ছিলেন লুই পাস্তুর। অ্যাকাডেমিক পড়ালেখায় খুব একটা ভাল ফলাফল ছিল না তাঁর। প্যারিসে একদিন তিনি বিখ্যাত রসয়ানবিদ অধ্যাপক দুমার বক্তৃতা শুনতে গেছিলেন। এই বক্তৃতাই লুই পাস্তুরের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। পাস্তুর রসায়নের রসে পুরোপুরি মজে গেলেন। তাই তো খারাপ ফলাফল থাকা সত্ত্বেও তিনি লিল শহরের সরকারি কলেজে রসায়ন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হতে পেরেছিলেন।



চিত্র: লুই পাস্তুরের নিজের হাতে আঁকা তাঁর বাবার ছবি


লুই পাস্তুরই প্রথম প্রমাণ করেন যে, কোনো কিছু পঁচে যাওয়ার পিছনে দায়ী হচ্ছে জীবাণু। এই জীবাণুগুলো এতই ছোট যে এগুলোকে খালি চোখে দেখা যায় না। দুধ যে টকে যায় তার পিছনে রয়েছে এই জীবাণু। মাঝারি তাপে কিছুক্ষণ ধরে দুধ ফোটালে এই জীবাণুগুলো মারা যায়। লুই পাস্তুরের নাম অনুসারে এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় পাস্তুরিতকরণ (Pasteurization)


সেসময় ফ্রান্সের অন্যতম প্রধান শিল্প ছিল রেশম শিল্প। রেশম তৈরি হয় গুটিপোকা থেকে। এজন্য গুটিপোকাকে রেশমপোকাও বলা হয়। সেসময়ে অজানা কারণে হাজার হাজার গুটিপোকা মারা যাচ্ছিল, লক্ষ লক্ষ টাকার রেশম নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। অনেকেই এটি নিয়ে গবেষণা করলেও কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিল না। অবশেষে লুই পাস্তুর টানা তিন বছর নিরলস গবেষণা করে আবিষ্কার করেন যে গুটি পোকার রোগ হচ্ছে বংশগত। তাই তিনি রেশম চাষীদের নির্দেশ দেন রোগাক্রান্ত গুটিপোকা বাদ দিয়ে একেবারে নতুন রোগমুক্ত গুটিপোকা দিয়ে রেশম চাষ নতুন করে শুরু করতে। এর সুফল হাতে-নাতে পেয়েছিল রেশম চাষীরা।

লুই পাস্তুর কলেরা থেকেও মুরগি শিল্পকে রক্ষা করেন। এমনি এমনি তো আর তৃতীয় নেপোলিয়ন তাঁকে ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে ঘোষণা করেন নি!





লুই পাস্তুর কতবড় বিজ্ঞানী ছিলেন তা বোঝার জন্য আরও একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। পাগলা কুকুরে কামড়ালে জলাতঙ্ক রোগ হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে তখন পর্যন্ত জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে কেউ বাঁচে নি। পাস্তুর চিন্তা করলেন, কলেরা, অ্যানথ্রাক্স ইত্যাদি রোগ যদি জীবাণু থেকে হয় তাহলে নিশ্চয়ই জলাতঙ্ক রোগ কোনো না কোনো জীবাণুর কারণে হচ্ছে। পাস্তুর খেয়াল করলেন পাগলা কুকুরের মস্তিষ্ক যদি সুস্থ কুকুরের মাথায় প্রতিস্থাপন করা হয় তাহলে সুস্থ কুকুরও পাগল হয়ে যায়। এ থেকে তিনি বুঝতে পারলেন যে জলাতঙ্কের জীবাণু মস্তিষ্ক বা শিরদাঁড়ার নির্যাসে থাকে। তিনি ভেড়ার অ্যানথ্রাক্স রোগ যেভাবে সারিয়েছিলেন এইবারও সেই একই পদ্ধতি অবলম্বন করার কথা ভাবলেন। ভাবলেন তিনি নিজের উপরই প্রথম পরীক্ষাটি করবেন। সেই সময়েই তাঁর ল্যাবরেটরিতে আসে এক ছেলে। ছেলেটিকে পাগলা কুকুরে কামড় দিয়েছে। সবাই ভেবেছিল জলাতঙ্কে রোগে ছেলেটি মারা যাবে। কিন্তু পাস্তুর হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তিনি ঐ ছেলের দেহে জলাতঙ্কের টিকা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন। আবারও চারিদিকে পাস্তুরের নামের জয়জয়কার।


অন্যান্য রোগের টিকা আবিষ্কার করার জন্য লুই পাস্তুর একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন। তাঁর প্রস্তাবে সাড়া দেন ব্রাজিল, তুরস্কের সম্রাটসহ আরও অনেকে। খোদ ফরাসি দেশের প্রেসিডেন্ট পাস্তুর ইন্সটিটিউটের উদ্বোধন করেন।




১৮৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পাস্তুর ইন্সটিটিউটের পরিচালক থাকাকালীন লুই পাস্তুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শেষ করা যাক তাঁর একটি উক্তি দিয়ে- ‘সাফল্য তার কাছেই এসে হাজির হয়, এর জন্য যে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে’।


Writer: Marshal Ashif Shawkat

BUET BME’19