পড়ুয়া সেই ছেলেটি

রাত তিনটা। চারিদিকে শুনশান নিরবতা। বাড়ির সকলেই তখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। একটি ঘর থেকে তখনও প্রদীপের আলো ভেসে আসছে। সেই আলোয় বসে পড়াশোনায় বুঁদ হয়ে আছে এক কিশোর। কঠিন পড়াশোনাগুলো করার এই তো সময়! কিন্তু প্রদীপের তেল তো শেষ হয়ে আসছে। এখন কী উপায়? ঘরের কোণে এক শিশিতে রাখা ছিল মাথায় মাখার সুগন্ধী তেল। ভবিষ্যতের এই রসায়নবিদ সেই সুগন্ধী তেলটুকু খরচ করলেন প্রদীপের জ্বালানি হিসেবে। বাকি পড়াশোনাটুকু শেষ করতে হবে তো!


ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় প্রচণ্ড আগ্রহ তাঁর। কিন্তু বিধি বাম! ভুগছে আমাশয়ে। না পারছে স্কুলে যেতে, না পারছে বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলতে যেতে। সময় আর কাটে না। সময় কাটানোর জন্য মাথা গুঁজে পড়ে থাকল পারিবারিক লাইব্রেরিতে। সেখানে বসেই নিজে নিজে ল্যাটিন ভাষা আয়ত্ত করে ফেলল ১৩ বছরের এই ছেলেটি। লেথব্রিজ, গোল্ডস্মিথ, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, স্টুয়ার্ড মিল, নিউটন, গ্যালিলিও আঁচড় কেটে গেল ছেলেটির মানসপটে।



সেই কিশোর এখন যুবক। প্রায়ই প্রেসিডেন্সী কলেজে যান অধ্যাপকদের বক্তৃতা শুনতে। তখন কি কে জানত এই বক্তৃতাগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল বাংলার বিজ্ঞান জগতের রেনেসাঁর সূচনা সৃষ্টিকারী বীজ! সেই বীজ থেকে গাছ হল এবং সেই যুবক তাঁর বাকিটা জীবন রসায়নের গবেষণায় উৎসর্গ করলেন।


রসায়নের জ্ঞান সুদৃঢ় করার জন্য তিনি চলে গেলেন বিলেতে, এডিনবার্গ কলেজে। কলেজ কর্তৃপক্ষকে তাক লাগিয়ে তিনি ডিএসসি (ডক্টর অব সায়েন্স) ডিগ্রি লাভ করেন। দেশপ্রেম তাঁকে ফিরিয়ে আনল জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলায়। বিলেতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন ভবিষ্যতের বিজ্ঞানী তৈরি করার প্রয়াসে। তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের দীক্ষা দিতে থাকলেন 'পড়ো পড়ো পড়ো'। তাঁর বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, কুদরাত-ই খুদা প্রমুখ।


হবু বিজ্ঞানীদের যাতে চাকরি নিয়ে চিন্তা করতে না হয় সেজন্য প্রতিষ্ঠা করেন বাংলার প্রথম পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি।এছাড়াও গড়ে তোলেন কৃষি ঋণদান সমিতি এবং সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক।


দেশের প্রয়োজনে ল্যাবরেটরির টেস্ট টিউব ছেড়ে যোগ দেন স্বদেশী আন্দোলনে। এজন্য গোয়েন্দা মহলে তিনি 'বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী' খ্যাতি পান।


যেই মানুষটাকে নিয়ে এত কথা, তাঁর নাম কি আমরা জানি? তিনি হচ্ছেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।