অ্যাবাকাস থেকে আধুনিক কম্পিউটারঃ প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা

Computer শব্দটির উৎপত্তি মূলত ‘Compute’ শব্দ থেকেই যার অর্থ ‘গণনা’ । গণনা যন্ত্র হিসেবেই কম্পিউটারের ধারণার সূত্রপাত হয় ‘অ্যাবাকাস’ নামক একটি যন্ত্র থেকে।


অ্যাবাকাস হল পৃথিবীর বুকে প্রথম গণনাকারী যন্ত্র। এর প্রথম ব্যবহার হয় মিশরে প্রায় খৃষ্টপূর্ব দশম শতাব্দিতে যার চূড়ান্তরূপ প্রকাশিত হয় দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দে, চীনে।

চীনের ব্যবহৃত অ্যাবাকাস

তাদের আবিষ্কৃত অ্যাবাকাসটি কাঠের তৈরি। এর দুটি অংশ ছিল উপরের অংশটিকে বলা হত স্বর্গ আর নিচের অংশটিকে বলা হত পৃথিবী।
আস্তে আস্তে গণনাযন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকলে বিজ্ঞানীরা নতুন করে ভাবতে শুরু করেন। বিভিন্নভাবে গণনা যন্ত্রের বিকাশ হতে থাকে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৬১৭ সালে ‘নেপিয়ার বোনস্’ যন্ত্রের আবিষ্কার। স্কটিশ বিজ্ঞানী নেপিয়ার তার এই যন্ত্র ব্যবহার করে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করতে পারতেন।

                                           নেপিয়ার ও নেপিয়ার বোনস্ যন্ত্র

পরবর্তিতে ১৬৪২ সালে ফ্রান্সের বিজ্ঞানী প্যাসকেল ‘প্যাসকেল’ ক্যালকুলেটরটি তৈরি করেন, এতে তিনি সংখ্যার অবস্থানকে গিয়ারে প্রকাশ করতে পারতেন।

১৬৭১ সালে জার্মান গণিতবিদ লেইরেঞ্জ প্যাসকেলের ক্যালকুলেটরটি আরো উন্নত করেন যাতে গুণ ও ভাগ করা সম্ভব হয়।

১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ব্যাবেজ প্রচলিত যন্ত্রে এক বিপ্লবী পরিবর্তন আনেন অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন আবিষ্কার করে। মূলত এখান থেকেই কম্পিউটারের অগ্রযাত্রা শুরু।

চালর্জ ব্যাবেজ এর এই অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিনের পরিপূর্ণতা দেন অ্যাডা লাভলেস। তিনি এই যন্ত্রের সাথে প্রোগ্রামিং যুক্ত করেন। এখান থেকেই প্রোগ্রামিং ধারণার সূচনা।

পরবর্তিতে ডক্টর হাওয়ার্ড, অ্যাডা লাভলেসের গবেষণার ওপর কাজ করেন। ১৯৪৪ সালে অসংখ্য বিজ্ঞানীদের গবেষণা ফল হিসেবে  IMB কোম্পানী প্রথম MARK I তৈরি করেন যা লম্বায় ৮ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ৫৫ ফুট।

এই MARK I একটি সাধারণ গুণ সম্পন্ন করতে ৩ থেকে ৫ সেকেন্ড সময় নিত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার সেনাবাহিনী দ্রুত গণনার জন্য নতুন যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এ জন্য সেনাবাহিনী ডক্টর মুসলে কে দায়িত্ব দেন। ডক্টর মুসলে J. Presper Eckert, Atomasff, এবং Berry এর সাথে কাজ শুরু করেন। অবশেষে তারা ENIAC (Electronic Numerical Integrator and computer) তৈরি করেন যা এক সেকেন্ডেই পাঁচটি গুণন শেষ করতে সক্ষম হত। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, যদিও যুদ্ধের প্রয়োজনে আমেরিকান আর্মি মুসলেকে এই গণনা যন্ত্রটি তৈরি করতে বলেছিলেন, কিন্তু মুসলে এটি তৈরি করতে এত বেশি সময় নেন যে যুদ্ধ শেষ হবার দু’মাস পরেও তা সম্পন্ন হয়নি।

ENIAC এর দ্রুতগতির ফলে তার ব্যবহার বেশ কার্যকর হয়ে ওঠে। কিন্তু ENIAC ব্যবহারে যে সমস্যাটি বড় হয়ে ওঠে তা হলো, যখন ব্যবহারকারী নতুন কোন গণনা কাজ করেন তখন আগের কাজটি সম্পূর্ণভাবে মুছে যায়।

এ ব্যাপারে J Prespe Eckert বিখ্যাত গণিতবিদ জন ভন নিউম্যান এর সাথে যোগাযোগ করেন। এ সমস্যা নিরসনে জন ভন নিউম্যান এক নতুন ধারণার প্রবর্তন করেন, “তথ্য সংরক্ষণ”, এর ফলে কম্পিউটার নতুন কোন কাজ শুরু করেও তার আগের কাজে ফিরে যেতে পারত। এ আবিষ্কারের পর ENIAC নতুন বাণিজ্যিক রূপ নেয় UNIVAC হিসেবে।

পরবর্তিতে ভ্যাকুয়াম টিউব অবিষ্কৃত হলে “তথ্য সংরক্ষণ” এর ধারণাটি আরো এগিয়ে গেল। ভ্যাকুয়াম টিউব তথ্য সংগ্রহের জন্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমের পরিবর্তে ব্যবহৃত হতে শুরু করল।

১৯৫৩ সালে IBM কোম্পানি “IBM-701” মডেলের মোট ১৯টি কম্পিউটার তৈরি করে যারা বিশাল আকারের ও অনেক ধীর গতি ছিল। তবুও IBM কোম্পানি আশা করেন যে এই ১৯টি কম্পিউটার সমগ্র আমেরিকার বাণিজ্যিক হিসাব সম্পন্ন করতে যথেষ্ট।

১৯৫৭ সালে “তথ্য সংরক্ষণ” এর ধারণাটি আরো একধাপ এগিয়ে যায়। আবিষ্কৃত হয় ম্যাগনেটিক ড্রাম। এতে প্রায় একুশ পৃষ্ঠার সম পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণ করা যেত।

১৯৫৭ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যেই কম্পিউটার জগতে এর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। কম্পিউটার পরিচালনা সহজ করতে 0 এবং 1 কে বেছে নেওয়া হয়, উদ্ভব হয় বাইনারি সিস্টেম এর। সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হল, তথ্য সংরক্ষণের জন্য ম্যাগনেটিক কোর ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এছাড়াও সূচনা হয় আন্ত—কম্পিউটার যোগাযোগ।


পরির্তিতে ডক্টর ডেনিয়েল ইনপুট আউটপুটের বিষয়টি সহজ করে আনেন। ১৯৬৪ সালে
তার অবদান ILLIAC-IV তৈরি হয় যাতে ‘তথ্য প্রদান’ ‘তথ্য গ্রহণ’ ও ‘তথ্য প্রক্রিয়াকরণ’ এ তিনটি কাজ একসাথে সম্পন্ন হত। এটিই ছিল প’থম “সুপার কম্পিউটার”

১৯৫৮ সালে Jack St. Clair Kilby এবং Robert Noyce প্রথম সমন্বিত বর্তনী তৈরি করেন যেখানে একটি সিলিকন চিপ এর মধ্যে অনেকগুলো ট্রানজিস্টর ও বর্তনী সমন্বিত করে রাখা যায়।

১৯৬২ সালে এই সমন্বিত বর্তনীর ওপর ভিত্তিকরে  DEC (Digital Equipment Corporation) কোম্পানি প্রথম মিনি কম্পিউটার তৈরি করেন। এতে সিলিকন চিপ ব্যবহার করা হত বলে এর নামকরণ করা হয় ‘সিলিকন ভেলি’ পরবর্তিতে ১৯৬৫ সালে PDP-8 মডেলের প্রথম মিনি কম্পিউটার বাজারজাত করা হয়।

১৯৭০ সালে ডক্টর টেড হফকে ডিজিটাল ঘড়ির জন্য একটি সার্কিট তৈরি করতে দায়িত্ব দেয় ইন্টেল কর্পোরেশন। তিনি এই সার্কিট তৈরি করতে গিয়ে ভাবেন যে তিনি অনুরূপভাবে কম্পিউটারের সকল সার্কিট একটি ‘চিপ’ নিয়ে আসতে পারবেন। তিনি একটি ক্ষুদ্র বা টিনি ‘চিপ’ মডেল কল্পনা করেন। যা পরবর্তিতে Intel-4004 রূপে বাজারে আসে। এটিই ছিল প’থম মাইক্রোপ্রসেসর।

এই মাইক্রোপ্রসেসরের ওপর ভিত্তি করে ইন্টেল কর্পোরেশন ১৯৭৫ সালে MITS Altair নামে প্রথম

মাইক্রো কম্পিউটার বাজারজাত করেন যাতে Intel 8800 চিপ ব্যবহার করা হয়।

পরবর্তিতে Steve Jobs এবং Steve Wozriak ১৯৭৬ সালে অ্যাপল কম্পিউটার নামে একটি কোম্পানি গঠন করেন। প্রথমে
তারা অ্যাপল-I নামের একটি মাইক্রোপ্রসেসর বোর্ড তৈরি করেন যা পরবর্তিতে অ্যাপল-II কম্পিউটারের জন্ম দেয়।

মূলত এই অ্যাপল-II ই ছিল প’থম পার্সোনাল কম্পিউটার এটি তখন বাজারে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে।
আইবিএম তাদের প্রথম পার্সোনাল কম্পিউটার তৈরি করে ১৯৮৯ সালে “Acorn” নামে যাতে Microsoft MS-DOS অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহৃত হয়। এর চিপটি ছিল Intel এর এবং এতে দুটি ফ্লপি ডিস্ক এবং একটি রঙিন মনিটরও ছিল।

১৯৮৩ সালে অ্যাপল LISA (Local Integrated Software Architecture) নামে আরেকটি পার্সোনাল কম্পিউটার তৈরি করে যাতে এর ব্যবহারকারীরা নিজেদের মধ্যে চিত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারে (একে Graphical User Interface বা সংক্ষেপে GUI বলা হয়)।

অন্যদিকে Alan Kay নামে এক ব্যক্তি Xerox PARC এর সহায়তায় ১৯৭৬ সালে থেকেই Xerox-Note তৈরির কাজ করছিলেন কিন্তু ১৯৮১ সালে Osborne Computer Corporation প্রথম Osborne-I নামের ল্যাপটপ বাজারে আত্মপ্রকাশ করে।

কিন্তু একই সালে অর্থাৎ ১৯৮৩ সালে Gavilan SC নামের ল্যাপটপ বাজারে আসলে তা প্রথম ল্যাপটপ হিসেবে পরিচিতি পায়। এর মূল্য ছিল প্রায় ৪০ হাজার ইউএস ডলার।

১৯৮৫ সালে মাইক্রোসফট কোম্পানি উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের ঘোষণা দেয় যা কম্পিউটারের অডিও এবং ভিডিও ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। একই বছর ইন্টারনেট ও ডট কম (.com) ডোমেইন সিস্টেম চালু হয় এবং মাত্র ১০০ টি (.com) রেজিস্ট্রি পায়। এর পরের বছরই টিম বার্নার্স লি ওয়াল্ড ওয়াইড ওয়েব (www) এর সূচনা করেন।
১৯৯৩ সালে Pentium মাইক্রোপ্রসেসর এর ফলে কম্পিউটারে গ্রাফিক্স ও মিউজিক সিস্টেমে বেশ এগিয়ে যায়। ১৯৯৯ সালে কম্পিউটার জগতে নতুন করে একটি শব্দ যুক্ত হয় “Wi-Fi” । এর সাহায্যে কোনো প্রকার তারের সংযোগ ছাড়াই ব্যবহারকারীরা ইন্টরনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়।

২০০৫ সালে ইউটিউব চালু হলে ইন্টারনেট জগত এক ধাপ এগিয়ে যায়। ২০০৬ সালে অ্যাপল সূচনা করে “Mac Book Pro” নামক ডুয়েল কোর কম্পিউটারের।

২০০৭ সালে i-Phone স্মার্টফোনেই কম্পিউটারের অনেক সার্ভিস নিয়ে আসে। i-Phone এর সর্বশেষ মডেল হলো

i-Phone 12,mini, 12, 12 Pro, 12 Pro Max, i-Phone I3

২০০৯ সালে মাইক্রোসফট চালু করে Windows 7 । এতে যেকোনো এপ্লিকেশনকে টাস্কবারে পিন করে রাখা যায়। ক্রমান্বয়ে Windows 8, Windows 10 এবং বর্তমানে Windows 11 Version বাজারে আত্মপ্রকাশ করেছে।
২০১০ সালে ‘অ্যাপল’ কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসে i-Pad যাতে কম্পিউটারের প্রায় বেশির ভাগ সেবাই যুক্ত করা হয়েছে।

২০১৫ সালে অ্যাপল কোম্পানির “Apple Watch” বাজারে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

পার্সোনাল কম্পিউটার পরবর্তীতে IBM, Apple, Intel সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় বিভিন্ন ধাপে বিকাশিত হয়। কম্পিউটার বিকাশ ও তথ্যযাত্রা থেমে নেই। এই একবিংশ শতাব্দিতে এসে কম্পিউটার আমাদের কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে বাসা সর্বত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে এর কর্মক্ষমতা ও কর্মক্ষেত্র।


তথ্য উৎস্য:

দি রয়েল সায়েন্টিফিক পাবলিকেশন্স কর্তৃক প্রকাশিত

ICT Exercise Book SSC

ICT Exercise Book HSC




Jahid Mahmud
BSc. BUET
jahidmahmud4@gmail.com